“আরডিএ থেকে রাজস্ব বঞ্চিত সরকার, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, দূর্নীতিবাজদের জয়জয়কার”
আবুল হাশেম, রাজশাহী বিভাগীয় প্রতিনিধিঃ
নানা অনিয়ম আর দূর্নীতিতে ১৩ বছর থেকে সরকারের প্রায় ২২ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি সাধন করেছে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। সরকারের রাজস্ব ক্ষতি সাধন করে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা মালিক হয়েছেন কোটি কোটি টাকার। সরকারের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ ও কিছু ঠিকাদার এমনই অভিযোগ উঠেছে আরডিএ কর্তৃপক্ষের কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। সরকারের পকেট কেটে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের পকেট ভর্তে ব্যস্ত।
পরিকল্পিত নগরায়ণ ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৩ বছর আগে রাজশাহী মহানগরীর ৯টি স্থানে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের মাধ্যমে দোকান বরাদ্দ দিয়ে সরকারের রাজস্ব আদায়ের কথা; কিন্তু পরবর্তীতে আরডিএ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনিয়ম ও অবহেলায় এক যুগে প্রায় ২১ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৫০ টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিকল্পিত নগরায়ণ, উন্নয়ন ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরডিএ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ২০০৯ সালে একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় সরকার তার নিজ অর্থ খরচ ছাড়াই পুরনো এবং পরিত্যক্ত জায়গায় নগরায়ণ করবে এবং সরকারি রাজস্ব বাড়াবে। এ কাজটি সম্পন্ন হবে দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ ঠিকাদারের মাধ্যমে (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ-পিপিপি পদ্ধতিতে)। আরডিএ কর্তৃক সরকারিভাবে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে ঠিকাদার নিজ অর্থায়নে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করবেন। বিনিময়ে ঠিকাদার পাবেন ওই ভবনের বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তোলা দোকানগুলোর সালামির অর্থ (সরকারি নির্ধারিত)। কিন্তু এভাবে ২০০৯ সালের পর থেকে বাণিজ্যিকভাবে নির্মাণ করা ভবনের কাজে নিযুক্ত ঠিকাদাররা অনেকটায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঠিকাদারদের অভিযোগ, ভবন নির্মাণে কোটি টাকা খরচ করে পড়েছেন বিপাকে, পাচ্ছেন না বরাদ্দও। কয়েক ঠিকাদার যতসামান্য বরাদ্দ পেলেও তাতে আরডিএর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হয়েছে। পরবর্তীতে অনিয়ম ও বরাদ্দ না পাওয়ার অভিযোগ তুলে মুখ ফিরিয়ে নেন ঠিকাদাররা। এতে ব্যাহত হয় নির্মাণ কাজ। এতে সরকার অব্যাহতভাবে রাজস্ব হারাতে থাকে। তারা আরো জানান, সাধারণ ব্যবসায়ীরা আরডিএর নির্মিত দোকান বরাদ্দ পেতে যথারীতি আবেদন করেন ও অর্থ জমা দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এতে অনেকটায় বিপাকে ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন ব্যবসায়ীরা। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরডিএর নির্ধারিত ভাড়া বাবদ প্রতি স্কয়ার ফুটে গড়ে তিন টাকা করে ভাড়া পায় আরডিএ কর্তৃপক্ষ। আবার তিন বছর পরপর ভাড়া বৃদ্ধি হয় শতকরা ১৫ শতাংশ হারে। সেক্ষেত্রে শতকরা ১৫ শতাংশ ছাড়াই প্রায় এক যুগে ৯টি মার্কেটের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৩ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৫৯৪ টাকা। অন্যদিকে, চার দফায় ১৫ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি বাবদ সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ৭ কোটি ৮৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৫৬ টাকা। প্রায় এক যুগে ক্ষতি হয়েছে ২১ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৫০ টাকা।
ভবন নির্মাণের সাথে যুক্ত ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরেজমিন পরিদর্শনে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আরডিএ কর্তৃপক্ষ নগরীর সাহেব বাজারে ৬ তলা বিশিষ্ট দক্ষিণ ছাউনি মার্কেট নির্মাণের অনুমতি দেয়। তবে মার্কেটটি নির্মিত হয় ৪ তলা পর্যন্ত। এটি নির্মাণ করেন ঠিকাদার ইফতেখার হাফিজ খান। নির্মিত ৪ তলার আয়তন ২১ হাজার ৯৩৯ বর্গফুট। কিন্তু বাকি ২ তলার কাজ পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষের অবহেলায় বন্ধ হয়ে যায়। এতে আরডিএ প্রতি মাসে রাজস্ব হারাচ্ছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৫৭৪ টাকা এবং ১৩ বছরে আরডিএ তথা সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ২ কোটি ৯৪ লাখ ১৭ হাজার ৫৯৪ টাকা।
অন্যদিকে ২০০৯ সালে সাহেব বাজার আরডিএ দক্ষিণ ছাউনি ফুটপাতের ওপর নির্মিত হয় ৫ তলা বিশিষ্ট একটি বাণিজ্যিক ভবন। মার্কেটটির প্রতি ফ্লোর (তিন দিকে) ৬ হাজার বর্গফুট। সে হিসেবে ৫ তলা মার্কেটটির আয়তন দাঁড়ায় মোট ৩০ হাজার বর্গফুট। দোকান বরাদ্দ না হওয়ায় ও জবরদখল হওয়ায় প্রতি মাসে ৯০ হাজার টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। সে ক্ষেত্রে ২০০৯ সালে নির্মিত এই মার্কেট থেকে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ছিল আরডিএ কর্তৃক নিয়োগকৃত সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষে ক্লাইমেক্স ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড।
২০১২ সালে আরডিএ মার্কেটের ছোট-টিন, বড়-টিন ও ক্রোকারিজ ব্লকের ৪ তলা ভবনটি নির্মাণ হয়। এর আয়তন ৪২ হাজার বর্গফুট। এই ভবনটির মাসিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে ১০ বছরে রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ১ কোটি ৯৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ভবনটি নির্মাণ করেন ঠিকাদার রাশেদুল ইসলাম টুলু।
২০১০ সালে শিরোইল কাঁচাবাজারে নির্মিত ২৭ হাজার স্কয়ার ফুটের ৪ তলা বিশিষ্ট গৌধুলী মার্কেট। আরডিএর অযত্নে অবহেলায় ভবনটির ৩ ও ৪ তলা পরিত্যক্ত প্রায়। প্রতি মাসে এ ভবনটি থেকে রাজস্ব হারাচ্ছে ৫৪ হাজার টাকা এবং ১৩ বছরে ৮৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। ভবনটির নির্মাণ করেন ঠিকাদার শফিকুল আওয়াল খান। অভিযোগ উঠেছে, নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখা, বরাদ্দ না দেয়া এবং রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ না নেয়ার নেপথ্যে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে আরডিএর তিনজন সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমান চেয়ারম্যান, অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদ ও প্রকৌশল শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ হিল তারেক, সহকারী প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জামান (তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত এস্টেট অফিসার), উপসহকারী প্রকৌশলী আবুল কাশেম ও উপসহকারী প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান উল্লেখযোগ্য। অভিযোগ আছে, দূর্নীতির দায়ে চাকুরিচ্যুত মোস্তাক আহমেদের পৃষ্ঠপোষকতায় অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদ ও নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ হিল তারেক প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্লট ও বানিজ্যিক ভবনগুলো থেকে। তারা দীর্ঘদিন উক্ত অফিসে থেকে জড়িয়েছেন নানা অনিয়ম দুর্নীতিতে।
জানতে চাইলে অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদ (আরডিএ) বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্য নয়। আমি উক্ত বিষয়গুলোর দ্বায়িত পালন করি না। কথা বললে নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ হিল তারেক বলেন, আমার বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ আছে তা আপনারা লিখে দেন। কোন সমস্যা নাই। তবে আরডিএর এসব বাণিজ্যিক ভবন থেকে এ পর্যন্ত মোট কত টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আরডিএ’র চেয়ারম্যান মো: আনওয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, শুরু থেকেই মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে ত্রুটি রয়েছে। তবে এসব মার্কেট থেকে সরকার বিপুল টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। আরডিএ চেয়ারম্যান বলেন, বিষয়গুলো সমাধানে কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত আন্তরিক। আশা করছি, সমাধান হয়ে যাবে।
শিরোনাম :
“আরডিএ থেকে রাজস্ব বঞ্চিত সরকার, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, দূর্নীতিবাজদের জয়জয়কার”
- Reporter Name
- Update Time : ০৪:৩৭:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ নভেম্বর ২০২২
- ৯৩৪ Time View
Tag :
আলোচিত